প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার কয়েকটি ধাপ
একটু ভেবে দেখুন
আমাদের দেশে সংরক্ষিত আইন এ ৬ বছর হলে শিশুকে আপনি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হল বেশীরভাগ বেসরকারি স্কুল ছেলেমেয়েদের স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য যে যোগ্যতা মাপকাঠি নির্ধারণ করে তা অর্জনের জন্য ৩/৪ বছর বয়স থেকে মা বাবারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। এতে বাচ্চাদের মুক্ত স্বাধীন শৈশব বাধা গ্রস্থ হয়। এই পরামর্শমূলক নির্দেশিকাটি ৪/৫বছরের শিশুদের জন্য পড়ালেখা শুরু করিয়ে তাদেরকে অন্তত বই পড়তে পারা এবং তারা যা বলতে পারে তা লিখতে পারার মত যোগ্যতায় উপনীত করার জন্য অনুসরন করা যেতে পারে। শিক্ষিত একজন মা/বাবা ইচ্ছা করলে সন্তান কে বাসায় রেখে প্রতিদিন গড়ে ১/২ ঘণ্টা সময় তাঁর সন্তানের জন্য ব্যয় করতে পারেন। [তবে যে সব শিশুর মা বাবা দুইজন ই কর্মজীবী তাদের কথা সতন্ত্র] দেখবেন ইনশ’আল্লাহ আপনার সন্তান ৬ বছর হলে[বেসরকারি স্কুলের মাপকাঠি অনুসারেও] স্কুলে যাবার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করবে। আমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার যে প্লে-নার্সারি-কেজি এই তিনটি ধাপে তিনটি বছর সন্তান কে স্কুলে পাঠিয়ে আমরা শিশুর সত্যিকার চিন্তা বিকাশে সাহায্য করছি কিনা। এই তিন বছরের স্কুলের খরচ বহন করা অনেক পিতামাতার জন্যই কষ্টকর। অথচ এটা একটা সামাজিক প্রথায় পরিনত হবার কারনে তারাও এই কষ্টকর পদ্ধতি অনুসরন করে থাকেন। শিশু শিক্ষা যদি অনাকাঙ্খিত ব্যায়বহুল কোন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দি হয়ে যায় তবে স্বল্প আয়ের মা বাবার সন্তানের সুশিক্ষা কেমন করে হবে সেটা ভেবে দেখা দরকার। যদি মা বাবার এক বছরের ঘরোয়া প্রচেষ্টা একটি শিশুকে পড়তে এবং লিখতে শিখানোর জন্য যথেষ্ট হয় তবে কেন অযথা স্কুলিং?
অনুগ্রহ করে নিচের আলোচনা পড়ে দেখুন এবং যে কোন অস্পষ্টতার ক্ষেত্রে [পরিশেষে উল্লেখিত ঠিকানায়]যোগাযোগ করুন।
১. অক্ষর চেনা[২মাস]
আমরা চারপাশে যা কিছু দেখি সব কিছুরই একটা নাম আছে। একটা শিশু যখন এটা কি? ওটা কি? এমন প্রশ্ন করতে শুরু করে তখন এই উপলব্ধির সাথে তার যোগাযোগ হয়ে যায় যে একেকটা জিনিসের এক একটা নাম। নাম গুলোর প্রায় সব ই আমরা শুনি এবং মনে রাখি। শিশুরাও তেমনি অক্ষর গুলোর নাম শিখবে। শিশুরা যখন একটা কিছু দেখে তখন তারা কিছু বলতে চায়। কাজেই অ অক্ষরটা দেখে অ বলতে হবে এটা শেখানো কঠিন না। একটু সময় লাগবে কিন্তু যখন তারা পার্থক্য বুঝতে পারবে তখন আলাদা আলাদা অক্ষরের নাম তারা বলতে পারবে। উচ্চারন পদ্ধতির ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব আরোপ না করে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ তারা আলাদা করতে পারছে কিনা সে দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পার্থক্য কি করে বুঝতে হবে সেটা তাকে বুঝতে সাহায্য করতে হবে। পার্থক্য করার ক্ষমতা সব শিশুদের একরকম হয় না। কাজেই তাদের সময় দিতে কার্পণ্য করা যাবে না। অন্তত এক মাস সময় নেয়া যেতে পারে শিশুকে সব গুলো স্বরবর্ণ শেখাবার জন্য। এটা তাদের একেবারেই প্রথম পাঠ বলে সময়টা একটু বেশি লাগবে। ব্যাঞ্জন বর্ণ শিখবে পরবর্তী এক মাসে। বর্ণ চেনাবার সময় প্রতিটি বর্ণের প্রয়োগে শব্দের পরিচয় করাতে হবে। এর উদ্দেশ্য বর্ণগুলো তাদের কাছে অর্থপূর্ণ করা। ওইসব শব্দ বানান করান বা লেখানোর চেষ্টা করার কোন দরকার নেই। এর জন্য পরবর্তী ধাপ রয়েছে।
২. অঙ্কন শেখা[১মাস]
লিখবার জন্য দরকার সোজা দাগ এবং প্রয়োজনীয় বক্রতার দাগ টানা। সরাসরি অক্ষর লেখানোর চেষ্টা না করিয়ে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সোজা এবং বাঁকা দাগ অঙ্কনের চর্চা করান যেতে পারে। এই ব্যাপারে দক্ষতা তৈরি হবার পর তাদের বলা যেতে পারে অক্ষরের ছবি আঁকতে। তখন তাদের জন্য অক্ষর লেখা তেমন কঠিন হবার কথা না।
[অক্ষর চেনা এবং অঙ্কন শেখা এই দুটি প্রশিক্ষণ সমান্তরালে চলবে। পেন্সিল ধরার পর থেকেই শিশুকে জোড় করে অক্ষর লেখানোর চাইতে তাদের কিছু আঁকা আঁকি করার স্বাধীনতা দেওয়া উচিৎ। পেন্সিল হাতে নিয়ে যখন তারা দাগ দেওয়ার আনন্দ পাবে, অঙ্কন শেখার প্রকৃয়ায় তখন তারা স্বতঃস্ফূর্ত হবে। দৃশ্যমান বস্তুর আকৃতি পেন্সিল দিয়ে খাতায় অনুকরন করতে গেলে শিশুরা নিজেদের অপারগতা বুঝতে পারবে। তখন তাদের সহজ দাগ টেনে আঁকা যায় এমন বস্তু এঁকে নাম জিজ্ঞেস করতে হবে। যদি শিশু চিনতে পারে তাহলে তাকে সেটা আঁকতে বলতে হবে। ]
৩. অক্ষর লেখা[১মাস]
আঁকার ব্যাপারে কিছুটা দক্ষতা অর্জনের পর শিশুরা যখন অক্ষর লিখবে তখন স্বরবর্ণ দিয়ে শুরু করবে। যে শিশু দেখে দেখে কোন সুনির্দিষ্ট বক্রতার দাগ টানা শিখে গেছে সে শিশু তার চেনা অক্ষর এমনিতেই লিখতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড এর প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের বর্ণ লিখন পদ্ধতি তাকে ব্যাপারটা আরও সহজ করে রপ্ত করতে সাহায্য করবে। তবে বিন্দু বিন্দু দিয়ে একটা বর্ণ আগে লিখে দিয়ে তার উপর হাত ঘোরানোর আগে দেখা দরকার একটা শিশু নিজেই দেখে দেখে বর্ণটা লিখতে পারে কিনা। কাছা কাছি আকারের লিখতে পারলে তাকে উৎসাহ দিতে হবে। এবং লেখা সুন্দর করার জন্য বই এর পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে। যুক্ত বর্ণ আগে না শেখানই ভাল হবে। যেমন শিশুরা যখন অক্ষর লিখা শিখছে তখন তাদের কাছে “অক্ষর” শব্দটা পরিচিত। কিন্তু “ক্ষ” বর্ণটা অপরিচিত। অক্ষর দিয়ে শব্দ লেখার ধাপে তাদের প্রসঙ্গিক শব্দের উদাহরন এনে “ক্ষ” এর মত যুক্ত বর্ণ সহজেই শেখানো যাবে।
৪. স্বর চিহ্নের ব্যবহার[১মাস]
স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ লেখা শিখে ফেলার পর এটা শেখানো শুরু করলে শিশুদের কাছে এটা অর্থপূর্ণ হবে। স্বরবর্ণ থেকে স্বর চিহ্ন হয় এটা বুঝাতে গেলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যায় শিশুদের জন্য। তাই যেহেতু ওই বর্ণ গুলোর আলাদা ব্যাবহার আছে সে কারনে স্বর চিহ্ন আলাদা চিহ্নের মত করে শেখানই ভাল। লক্ষ্য করা জরুরী যে স্বর চিহ্নের ব্যাবহারের জন্য প্রথম যে উদাহরন দিতে হবে তা যেন অবশ্যই শিশুর কোন পরিচিত এবং আগেই উচ্চারিত শব্দ হয়। দুইটির বেশি স্বর চিহ্ন এক দিনে না শেখানই ভাল। (কা কি কু কো কৌ) এমন করে না শিখিয়ে কা খা গা ঘা চা মা লা ... এইরকম করে চিহ্নের ব্যাবহার শেখানো ভাল। বিভিন্ন শব্দ দেখিয়ে কোথায় ওই স্বরচিহ্নের ব্যবহার গুলো আছে তা খুজে দেখতে বললে শেখাটা আরও ফলপ্রসূ হবে এবং এভাবে শিখালে ৬ থেকে ১২ ক্লাসে সব গুলো স্বর চিহ্নের সাথে পরিচয় করানো যাবে। অনেক বাচ্চা ে কার এবং ো কার এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা। একটু সময় দিলে তারা শিখে ফেলবে। বাচ্চারা যখনই কিছু ভুল করছে তখন তার ভুল কে কারন সম্মত মনে করে ওই কারণটা খুঁজে দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
৫. অক্ষর দিয়ে শব্দ শেখা[১মাস]
এই ধাপে শিশুদের তাদের জানা শব্দগুলোর সাথে অক্ষরের সম্পর্ক বুঝাতে হবে। প্রতিটা অক্ষরের সাথে সম্পর্কিত এক বা একাধিক সহজ শব্দ তারা বানান করে পড়বে। কারন এর মধ্যে তারা স্বর চিহ্নের ব্যাবহার শিখে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে বানান করতে একটু কষ্ট হলেও একটা পূর্ণ শব্দ যা সে আগেই শুনেছে সেটার আকৃতি ধরেও শব্দটা শিশু চিনে ফেলতে পারে। এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করা উচিৎ এবং তারপর তাকে বানান করানোর চেষ্টা করা উচিৎ। উদাহরনস্বরুপ , ‘কম্পিউটার’ একটা জটিল শব্দ। কিন্তু এটা পরিচিত অন্য শব্দের সাথে আকৃতি বৈষম্যের কারনে শিশুকে চিনিয়ে দেওয়া সম্ভব। সে যখন শব্দটা চিনল তখন বানান করে পড়া তার জন্য আর কঠিন হবে না।
৬. পূর্ণ বাক্য পড়তে শেখা[১মাস]
শিশু এখন পূর্ণ বাক্য পড়তে শিখবে। বড় বড় করে লিখে সহজ সহজ বাক্য দিয়ে তাকে পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। যে কোন একটা বই থেকে সুনির্দিষ্ট বাক্য না দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে বিভিন্ন সহজ বাক্য বোর্ড এ লিখে দিয়ে পড়তে বলা উচিৎ। লেখা শুধু বই তেই থাকে না , রাস্তায় চলাফেরায় শিশুকে বিভিন্ন লেখা দেখিয়ে পড়তে উৎসাহিত করা যেতে পারে। লেখা দিয়ে জগত কে নতুন মাত্রায় বুঝতে পারা, এই ব্যাপারটা শিশু উপভোগ করবে। একটা শব্দ পড়ার পর সে মা বাবার কাছে অর্থ জানতে চাবে। শিশু যখন পড়তে পারে তখন তার শেখার জগৎ অনেক বড় হয়ে যায়।
৭. শব্দ লেখানো[১মাস]
এই ধাপে শিশুকে লিখা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যে যার মত করে জানা শব্দ পছন্দ করে লিখুক। সবার সময় একরকম লাগবে না। তাড়াহুড়ো না করে যে যেই শব্দটা বলতে পারে সেই শব্দ লিখতে তাকে সময় দিতে হবে। বিভিন্ন অক্ষর দিয়ে বিভিন্ন শব্দ শিশুর সামনে উচ্চারন করে বললে বা তাকে দিয়ে উচ্চারন করালে শব্দ গুলো তার জানা হবে। এর পর লিখতে বললে সে লিখবে। একটা অক্ষর দিয়ে ৫ টি শব্দ লিখ এই বাধ্যবাধকতার দরকার নেই।
৮. পূর্ণ বাক্য লিখতে শেখা[১মাস]
এই ধাপে শিশু যা বলতে পারে তাকে তাই লিখতে বলা যেতে পারে। বানান ভুল করলে তা তাকে বুঝিয়ে সংশোধন করে দিতে হবে। লেখা চর্চার জন্য কোন লেখা দেখে দেখে না লিখিয়ে বরং স্পস্ট উচ্চারণে মুখে বললে সেটা শুনে শুনে তারা লিখবে। তাদের জানা কোন সহজ বিষয়ের উপরে কথা বললে সে কথা শুনে শুনে তারা লিখতে আনন্দ পাবে। যুক্ত বর্ণ, জফলা, ঋ-কার, র-ফলা, হসন্ত ইত্যাদির ব্যবহার শব্দ প্রয়োগের বাস্তবতায় শিখাতে হবে।
সারে চার বছরের কোন শিশুর জন্য উপরের ৮ টি ধাপে মোট সময় নির্ধারিত ৯ মাস। প্রয়োজনে এক বছর সময় নেয়া যেতে পারে। প্রতিটি ধাপে শেখানো, চর্চা এবং মুল্যায়ন একসাথেই চলবে। মূল্যায়নের উদ্দেশ্য শিশুর অযোগ্যতা খুঁজে বের করা না বরং তাকে যোগ্যতার পথে উৎসাহিত করা। “ভাল হয়েছে”, “তুমি আরও ভাল করতে পারবে” , “কোন অসুবিধা নেই তুমি এটা আরেকবার চেষ্টা করলেই পারবে” এই সমস্ত কথা শিশুর উৎসাহ বাড়াবে। যে কোন নেতিবাচক উক্তি পরিহার করে ইতিবাচক উক্তি করতে হবে। কোন পরীক্ষা নিলে প্রশ্ন এমন হওয়া উচিৎ যেন শিশু যা জানে সেটা লিখতে পারে। প্রশ্ন কে সহজ করা উচিৎ যেন জানা উত্তর দিতে সে ভুল না করে। যেমন একটা শিশুকে প্রশ্ন করা হল “বলতো স্বরবর্ণ কয়টি?” সংখ্যা বলতে গিয়ে সে ভুল করে ফেলল। কিন্তু তাকে যদি প্রশ্ন করা হয় স্বরবর্ণ গুলো কি কি, তাহলে সে ঠিক ই বলতে পারবে। সে যদি হাতের কড়া দেখে গুনে গুনে বলে তাহলে ঠিক করে সংখ্যা ও বলতে পারবে।
বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে এবং পরিবেশের সাথে মেলামেশায় শিশু এমনিতেই সংখ্যা জ্ঞান লাভ করতে থাকে। কাজেই এই বিষয়ে খুব বেশী চিন্তিত না হয়ে শিশুকে একটু একটু করে শেখানোর চেষ্টা করুন। শিশুর সংখ্যা জ্ঞানের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড এর প্রথম শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত বইটি অনুসরন করতে পারেন। বাংলা পড়ালেখা শেখার পর ইংরেজি শেখানো ভাল। আলোচিত পদ্ধতিটি মুলত বাংলার জন্য। এক ই রকম করে সমান্তরালে ইংরেজি ও শুরু করা যেতে পারে তবে আমার পরামর্শ আগে মাতৃভাষা বাংলা, তারপর ইংরেজি।
মোহাম্মাদ আনোয়ারুল গনি
গণি একাডেমী
বাড়ি নং ৬ (নীচ তলা), ব্লক- জি, দক্ষিণ বনশ্রী (কেন্দ্রীয় মসজিদ-১ সংলগ্ন), ঢাকা-১২১৯।
ফোনঃ ০১৯১১৩২৩৭১১, ০১৭৫৯৭৭৩৩৪৪
ই-মেইল anwarulghani@yahoo.com
ওয়েব সাইটঃ www.ghaniacademy.org
|
|
|
সুশিক্ষা কি সোনার হরিন?
শিক্ষা নিয়ে ব্যাবসা হচ্ছে এই কথাটা বললে ব্যবসা কে অপমান করা হয়। তাই আমি বরং বলব শিক্ষা নিয়ে এমন এক শ্রেণীর মানুষ কিছু পেশাদার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন যাদের সুশিক্ষা সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারনা নাই কিংবা থাকলেও সেই ধারনা তাদের স্বার্থচিন্তার কাছে পরাজিত হয়ে গেছে। শিক্ষার মত এত গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নিয়ে কেও যখন কাজ করবেন তখন তাদের যে মন মানসিকতা থাকা দরকার যদি সেটা না থাকে তখন তাদের ওই কাজের দ্বারা সমাজ এবং জাতি ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। গত ১৫-২০ বছর ধরে আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এই প্রতিষ্ঠান গুলোর অনেক গুলোরই যথেষ্ট অবদান এবং সুনাম দুই ই আছে । কিন্তু প্রতিযোগিতার সমাজে টিকে থাকার প্রচেষ্টার বাস্তবতায় (বা অজুহাতে) তারা এখন যা করছে তা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কল্যাণের সে বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্ধারণ করা এবং সেটিকে যথাসম্ভব নিশ্চিত করে কারিকুলাম ঠিক করা এই ব্যাপারটি গোটা প্রকৃয়াতে আমি খুঁজে পাচ্ছিনা। এটা খুব ভয়ঙ্কর একটা সমস্যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য যে আমি আমার সান্তান কে যে শিক্ষন প্রকৃয়ায় ছেড়ে দিচ্ছি তা যারা ঠিক করছেন তারা শিক্ষার্থীর কল্যান অকল্যানের ব্যাপারে মোটেই সচেতন নন। তাদের আসল সচেতনতা এমন একটা সিস্টেম তৈরি করা
১.যাতে তারা প্রচুর স্টুডেন্ট পান।
২.স্টুডেন্ট রা যেন A+ পায়।
৩.শিক্ষন পদ্ধতির মুল্য যেন এমন ভাবে নির্ধারণ হয় যাতে করে তাদের যথেষ্ট financial turnout হয়।
প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল এবং কলেজ এই তিনের সমন্বয়ে এখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। যেখানে সন্তান কে ভর্তি করে অনেক অভিবাক ১২ বছরের জন্য নিশ্চিত হয়ে যান। এসব স্কুল শুরুতেই যে ভুল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষন প্রকৃয়া শুরু করে তার লেশ চলতে থাকে পরবর্তী ১২ টি বছর। স্কুলের সুখ্যাতির প্রভাবে কোন অভিভাবক চিন্তাও করতে পারেন না যে তার সন্তানের উপর রীতিমত অনাচার হচ্ছে। আমি এই লেখায় এই অনাচারের উদাহরন তুলে ধরার চেষ্টা করব।
এখন অনেক স্কুলেই প্লেগ্রুপ-নারসারি-কেজি বলে এই তিনটা ধাপ আছে। তিন বছরের এই শিক্ষণ ধাপ কে প্রিপ্রাইমারি স্টেজ বলা হয়। আপনি কোন স্কুল এ আপনার বাচ্চা কে ক্লাস ওয়ান এ ভর্তি করতে চাইলে আপনাকে জিজ্ঞেস করা হবে, আপনার সন্তান বোর্ডের লেখা দেখে দেখে খাতায় তুলতে পারে কিনা। অথচ প্রথম শ্রেণীর যে পাঠ্য বই সেখানে কয়েকটি লেসন পার হবার পর শুরু হয় অক্ষর শেখানর ধাপ। তাহলে আমার সন্তান বোর্ডের লেখা পড়তে পারলে তাকে আপনারা ক্লাস ওয়ানের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন, এর কারন কি? তাহলে যারা এই বই টি ক্লাস ওয়ানের জন্য পাঠ্য করেছেন তাদের ভুল হয়েছে? তারা উত্তর দেয়, আমাদের স্কুলে ওয়ানের আগে আরও ২/৩ টি ধাপ আছে যেখানে আমরা ওইগুলো শিখিয়ে দেই। তাহলে কি আমাকে ভাবতে হবে আমাদের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা আমাদের সন্তান দের শিক্ষন প্রকৃয়াকে ২/৩ বছর পিছিয়ে দিচ্ছে? ঠিক কোন বয়স থেকে একটা শিশু লেখা পড়া স্টার্ট করবে এবং তার শিক্ষণ উন্নতির মুল্যায়নের মাপকাঠি কি হবে সেটা কি আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় নেই? এর জন্য সরকারি যে নির্ধারণ আছে সেটা কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মান্য করছে না। কিন্তু তাদের (বেসরকারি দের) মুল্যানের মাপকাঠি যে ঠিক সেটা আমি কি করে বুঝব? সরকারি ৩ টা বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত ১০/১২ টি বই ক্লাস ওয়ানের জন্য পাঠ্য করার যুক্তি কি? যদি এটা দরকার হয়েই থাকে তাহলে সরকারি ব্যাবস্থায় সেটা নেই কেন? আমি এই অতিরিক্ত বই দাতা পণ্ডিত দের জিজ্ঞাসা করি, “আপনারা কি এই বইগুলি শিশুদের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করেন? ” উনারা বলেন এটা অভিভাবক দের চাহিদা। অভিভাবক দের কে তারা এই বুঝ দিতে চান যে তাদের সন্তান দের তারা অনেক অনেক শিখাচ্ছেন। কাজেই বইয়ের সংখ্যা যত বেশী হবে অভিবাকরা তাদের সন্তান দের সুশিক্ষা হচ্ছে বলে ধারনা করবেন। স্কুলের আর সমস্যা কি? বেশী বই বেশী কেনা বেচা এবং বেশী turnout. কিন্তু এটা যে আমাদের সন্তান দের মেধাশুন্য হবার একটি অপ্রত্যাগামী প্রকৃয়া সেটা কি ভেবে দেখা দরকার না? যখন শিশুর চিন্তা প্রকৃয়া (thought process) তৈরি হবার কথা তখন তার উপর অতিরিক্ত মানুষিক চাপ তার বিকাশ কে বাধাগ্রস্থ করে। ৬ বছরের শিশুকে বাংলা-অঙ্ক-ইংরেজি-সমাজিক বিজ্ঞান-ধর্ম-বাংলা ব্যাকরন-ইংরেজি ব্যাকরন-চারুকারুকলা-সাধারন জ্ঞান এই এতোগুলা বিষয় নিয়ে পড়তে হবে। তাকে শিখতে হবে বাংলাদেশ এ নদিবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের সংখ্যা, তাকে রোমান সঙ্খ্যালিপি জানতে হবে, তাকে ১-১০ পর্যন্ত নামতা জানতে হব, তাকে ইংরেজিতে প্যারাগ্রাফ লিখতে হবে আরও কত কি! এখানে কে বা কারা এইগুলা নির্ধারণ করেণ বা নির্ধারণের এখতিয়ার রাখেন তার সঠিক বা গ্রহনযোগ্য কোন উত্তর নেই। আমার স্কুল আমার নিয়ম আমার ইচ্ছা আমার ব্যাবসা এই হল সব কথার মুল কথা। দেখা যাচ্ছে পুরো প্রকৃয়া বন্দি হয়ে আছে এক ধরনের ঔদ্ধত্যের কাছে। কার সাহস আছে বা ক্ষমতা আছে স্কুলের সিস্টেমের বাইরে যাওয়া? কে পারবে নিজের সন্তানের জন্য একা স্কুল খুলতে? অনেক নামকরা স্কুল, অনেক স্টুডেন্ট তাদের, অনেক বড় বড় লোক তাদের গভারনিং বডিতে কিন্তু কই এমন একটা মানুষ যে একটা শিশুর সত্যিকারের ভালর কথা চিন্তা করে? আমি কি পিতা হয়ে সন্তান কে কুমিরের পাঠশালায় পাঠাচ্ছি? কোন এক স্কুলের বই লিস্ট এ লিখা আছে “আগের বছরের বই চলবে না” কিন্তু নতুন বছরের বইতে কোন পরিবর্তন নাই। তাদের ভাবনা হল যদি কারো বড় ভাই বা বোনের আগের বছরের বই কেও পড়ে তাহলে তাদের বিক্রি কম হবে।
এখন পি এস সি এবং জে এস সি পরীক্ষা চালু করায় ক্লাস ভিত্তিক মূল্যায়নের একটা জাতীয় পদ্ধতি আছে। পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হতে এবং অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ হতে যোগ্যতার একটা সরকারি মাপকাঠি আছে। এর পরেও কেন অতিরিক্ত বই? যে শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে ১৪ টি বিষয় পড়ে সে মাত্র ৬ টি বিষয়ের উপর প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষা দিবে। তাহলে ৫ টি বছর সে ওইসব বইয়ের বোঝা কেন টানল? এইরকম প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, যে শিশু প্রথম শ্রেণীতে এতোগুলা বিষয় পড়ে সে কেন ৫ম শ্রেণীতে মাত্র ৬ টি বিষয়ে পারদর্শী হতে পারেনা? তাদের ই একজনের উত্তর “আমরা ছোটবেলা থেকে বেশী বেশী বই দিয়ে তাদের মাথা নস্ট করে দেই।” আমি আমার মেয়ের স্কুলের মালিক পরিচয়ের একজন ডিরেক্টরের সামনে ক্লাস ওয়ানের (সরকারি) গণিত বই রাখলাম, সেটা দেখে তাকে একটা মতামত দিতে বললাম। তিনি অনেকখন বইটা দেখে উনিও আমাকে বললেন “এই বইটা ফলো করাই তো যথেষ্ট !” তাহলে কেন অতিরিক্ত বই? কেও হয়ত ভাববেন আমার অভিযোগ বই সংখ্যা নিয়ে। ব্যাপারটা তাও না। আমার কথা হল অতিরিক্ত বই দিলে আমি কেন দিব এবং কেমন বই দিব? কার লেখা বই দিব? যে বই দিব তা শিশুর জন্য উপকারি সেটা না বুঝে কেন দিব? এইখানে শিশুর ভবিস্যত ভালমন্দ চিন্তা করার দায়িত্ব কে নিচ্ছে? আমি কাকে বিশ্বাস করছি, কেন করছি? আমার সন্তান কার পরিকল্পনায় শিক্ষিত হচ্ছে? সে কি সুশিক্ষিত হবে? এবং এটা কি সম্ভব যে এমন পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতায় সে সুশিক্ষিত হবে যেখানে তার শিশুমনের সুন্দর চাওয়া গুলোর কোন মূল্যায়ন নেই? এই শিশুমনের সুন্দর চাওয়া কি সেটার একটা উদাহরন দিয়ে আমি আপাতত শেষ করব।
আমার মেয়ে ক্লাস ওয়ান এ পড়ে। গত কিছুদিন আগে তার স্কুলের বার্ষিক শিক্ষা সফর নামের একটা প্রোগ্রাম ছিল। এর চাঁদা ছিল ৮০০ টাকা। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাই, কাজেই আমাকে ১৬০০ টাকা দিতে হয়েছে। ওকে নিয়ে যখন আমি ফিরছিলাম ও তখন আমাকে ওর এক বন্ধুর নাম উল্লেখ করে বলছিল “আচ্ছা আব্বু আমরা কি ওর চাঁদা টা দিয়ে দিতে পারতাম না”।
ওর সেই বন্ধুরা দুই বোন এক সাথেই স্কুলে পড়ে, মা অথবা বাবার সাথে গেলে তিন জনের ২৪০০ টাকা চাঁদা লাগবে। বিষয়টা নিয়ে আমি আগেই প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে আপনারা যে এক্সপেন্সিভ আয়োজন করেছেন তাতে অনেকের ই ইচ্ছা থাকা সত্বেও যেতে পারবে না। চাঁদা বেশী বলে যাবে না এই কথা অনেকে লজ্জায় বলবেও না। কারন অনেকেই টাকা কম থাকার বাস্তবতা নিজের জন্য লজ্জাজনক মনে করেন। উপায় নেই বলে তাদের সন্তানের জন্য অতিরিক্ত বইয়ের দাম ও দিতে হয়। স্কুলের অতিরিক্ত চাপের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রাইভেট কোচিং এ পড়ার টাকাও যোগার করতে হয়। এর পর আবার শিক্ষাসফরের খরচ? কাহাতক!! পরে অবশ্য শুনেছি কারো কারো ক্ষেত্রে তারা এক দুইশ টাকা কম নিয়েছেন। আমার খুব খারাপ লাগলো, নিজেকে কিছুটা অপরাধিও মনে হল যখন দেখলাম ওর ক্লাসের ও ছাড়া আর মাত্র একজন গিয়েছে ওই অনুষ্ঠানে। আমার প্রশ্ন হল আমার মেয়ে কে তার বন্ধুদের সাথে মজা করার সুন্দর একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত কে করল? ওই স্কুলের শিক্ষক কি তার সুশিক্ষক? ওই পরিবেশ কি তার সুশিক্ষার পরিবেশ? আমরা কি কেবল শ্রেণীবিভক্ত সমাজের কথা বলেই দায়মুক্তি পাব?
মোহাম্মাদ আনোয়ারুল গনি
|
|
|
প্রি স্কুল থেকে শুরু এবং তারপর...
অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে যখন আমেরিকা এবং ইউরোপে শিল্প কারখানায় অনেক মহিলা শ্রমিক নিযুক্ত হতে থাকে তখন তাদের শিশুদের মাত্রিসেবা দেবার জন্য কিছু প্রি-স্কুলিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এবং সেই সমাজের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এর গ্রহণযোগ্যতাও প্রতিষ্ঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল মুলত শিশুরা যেন প্রাথমিক শিক্ষা লাভের ঠিক পূর্ববর্তী ধাপে তাদের মাত্রিসঙ্গ যথেষ্ট পরিমানে না পাওয়ায় নিগৃহীত বোধ না করে এবং যাতে তাদের সঠিক শারিরিক ও মনস্তাত্বিক বৃদ্ধি ব্যহত না হয়। অনেকটা এতিম খানায় বাচ্চাদের যেমন করে সেবা দেওয়া হয় তেমনি কর্মজীবী ব্যস্ত মা বাবার সন্তান দের পরিবার থেকে আলাদা থাকার ওই সময়টুকু যেন সঠিক ভাবে অতিবাহিত হয়। আমাদের দেশে এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রি স্কুলিং শুরু হয় মুলত পাশ্চাত্য কায়দায় গড়ে উঠা কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গুলোতে এবং ব্যাপক ভাবে এই চর্চার প্রসার ঘটতে শুরু করে গত প্রায় ২০ বছর ধরে। শুরুর দিকে এটা ছিল মুলত কিছু উচ্চবিত্তদের শিশুদের লেখাপড়া শুরু করার জায়গা কিন্তু পরবর্তীতে এই কনসেপ্ট ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে এবং এখন দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রতিটি শহর উপশহর এমনকি কোন কোন গ্রামেও কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে উঠেছে। আমাদের বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই প্রথার ব্যাপক প্রসারের ভাল বা খারাপ দিক কি আছে সেটা মনে হয় আমাদের ভেবে দেখা দরকার। এটা সহজেই অনুধাবন যোগ্য যে, যে শিক্ষা একটা শিশু কোন কিন্ডারগার্টেন থেকে শিখবে সেটা যদি সে তার পারিবারিক পরিবেশে মা বা বাবার কাছে শিখতে পারে তাহলে সেটাই তার জন্য মঙ্গল। যদি কোন পরিস্থিতিতে মা বাবা বা পারিবারিক পরিবেশ শিশুর জন্য সহায়ক না হয় তবে এটা আমাদের দায়িত্ব হবে ওই শিশুর জন্য এমন কোন সম্ভাব্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ তৈরি করা যা তাকে বিকশিত হতে সাহায্য করবে।
ঘুম থেকে উঠিয়ে ৪/৫ বছরের শিশুকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে শুরুতেই তাকে ৮/১০ টি বই খাতার একটা ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে কিন্ডারগার্টেন এর ক্লাস রুমে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে মা স্কুলের ওয়েটিং প্লেসে বসে নিশ্চিন্তে গল্প করবেন আর তার শিশু ক্লাস রুমে বসে তার খাতায় পেন্সিল ঘসবে আর মিস আর স্যার দের লিখে দেওয়া গাদা গাদা পড়া লিখে নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত থাকবে। আমাদের এখনকার কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলোর দৃশ্য অনেকটা এই রকমই। নার্সারি থেকে বাচ্চাদের তারা বইখাতা চিনিয়ে দেন এবং অক্ষর লেখা থেকে শব্দ বানান এমন কি যে সকল ব্যাপার সরকারি কারুকুলাম এ ক্লাস ওয়ানের সিলেবাসেও নেই সেগুলো পর্যন্ত তাদের করান হয়। এই বয়সের বাচ্চাদের লেখা পড়া যা কিনা একরকম স্বাধীন আনন্দময় পরিবেশে খেলার ছলে হয়ে যাবার কথা সেখানে তারা তাদের কে ক্লাস ওয়ার্ক আর হোম ওয়ার্কের বোঝা দিয়ে থাকেন। অনেক মা বাবা তাদের জন্য আবার আলাদা করে বাসায় শিক্ষক রেখে সেগুলো কমপ্লিট করান। ৫ বছরের শিশু রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে জেগে হোম ওয়ার্ক করে। যারা শিশুদের লেখা পড়াকে এইরকম কঠিন করে ফেলছে তারা শিশু অধিকার, শিশু শিক্ষা এবং শিশু মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে কতটুকু প্রজ্ঞাবান সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট কারন আছে। তবে তারা জানে যে এই সমাজে দায়সারা দায়িত্ববোধের অনেক মা বাবা আছেন যাদের শিক্ষা যতই থাকুক না কেন নিজেদের শিশুদের জন্য সময় দেবার যে মানসিকতা দরকার সেটা তাদের নেই। কাজেই শিশুদের সত্যিকারের অধিকারও তারা বুঝেন না। আর এইসব মা বাবার অজ্ঞতা এবং অসচেতনতাই হল কিন্ডারগার্টেন মালিকদের সুবিধা। কাজেই যখনই কোন অভিবাবক তার শিশুর ব্যাপারে নিজের দায়িত্বের অজ্ঞতা বা অসচেতনতা কে আবিস্কার না করে শিশুকে স্কুলে দেন তখন শিশুদের সত্যিকার শিক্ষা দানের পুরো ব্যাপারটা ওইসব পেশাদার শিক্ষা ব্যবসায়ী মহলের পরিকল্পিত ব্যাবসা পদ্ধতির কাছে বন্দি হয়ে যায়। এরা নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক মুনাফা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়ম কানুন তৈরি করেন। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নাম ছাপান খাতা ছাড়া চলবে না। ক্লাস ওয়ার্ক হোম ওয়ার্ক এর আলাদা খাতা লাগবে। এদের স্কুলের প্রতিটি বাচ্চাদের টাকার বিনময়ে আইডি কার্ড দিয়ে থাকেন যার মধ্যে বাচ্চাদের ছবি নাম ধাম এবং স্কুলের নাম ঝুলান থাকে। শিশুদের যে আসল পরিচয় সেটা থেকে তাদের কে একটু আলাদা করে স্কুল নামের একটা প্রাতিষ্ঠানিকতা তাদের স্টুডেন্ট এ পরিনত করেন। তখন মা বাবা রা হয়ে যান স্কুলের এনলিস্টেড গার্ডিয়ান এবং তাদের দায়িত্ব হয় স্কুলের ফরমায়েশ মতাবেক বাচ্চার সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাস্ত হয়ে যাওয়া। যেই ব্যাস্ততার প্রধান উপকরন হল টাকা। দেশের অত্যন্ত নামকরা স্কুলের পাশে গড়ে উঠে শ খানেক কোচিং সেন্টার। যেখানে শিশু শ্রেণী থেকে নবম দশম পর্যন্ত বাচ্চাদের নিয়মিত শিট সাপ্লাই করে কোচিং দেওয়া হয় এবং তারা A+ এর গ্যারান্টি দিয়ে থাকেন। স্কুল গুলো যে চাপ দেয় তার প্রশমন ঘটে এই সব কোচিং এর কল্যানে। একে তো স্কুলের খরচ তারপর আবার কোচিং এবং তারপরেও যদি স্কুলের পড়া সম্পন্ন না হয় তাহলে বাসায় প্রাইভেট টিউটর। অধিকাংশ নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীর এই পদ্ধতির কাছে বন্দিত্ব। এর সুত্রপাত হল একেবারে কেজি বা নার্সারি ক্লাশ থেকে। কারন যখন সে ছিল নিস্পাপ শিশু তখনি তাকে পরিনত করা হয়েছে নির্দয় শিক্ষাব্যবসার একটা উপকরনে। এর একরকম নিষ্কৃতি মিলে কারো কারো ক্ষেত্রে প্রচণ্ড আবেগে টেলিভিশন কেমেরার সামনে A+ প্রাপ্তির “V” চিহ্ন দেখিয়ে। শিক্ষার্থীরা তখন একরকম আপাত কিন্তু তীব্র সন্তুষ্টির আবেগে নিজেদের প্রতিষ্ঠান শিক্ষক এবং তারপরে মা বাবার গুণকীর্তন করে। কিন্তু যারা ওই অতকিছুর পরেও ভিক্টরি পেলনা তাদের ব্যারথতার দায় কে নিবে।
এর পরের ধাপ আরও দুঃখজনক। এইসব A+ প্রাপ্তরা যখন স্কুল থেকে পরবর্তী ধাপে কলেজে যায় তারা দেখে তারা কেবলই A+ পেয়েছে শিখতে পারেনি কিছুই। তখন আর কি করা আরও একটা A+ জন্য আবার কোচিং আবার প্রাইভেট শিক্ষক। তাদের ভাগ্যে তাদের মুনাফা আর জোটেনা। স্কুলের নাম হয় কলেজের নাম হয়। ব্যর্থতার দায় কেবলই তাদের “তারা আসলে ভাল স্টুডেন্ট না, তারা অযোগ্য! ”
ব্যাবহুল শিক্ষন প্রক্রিয়ায় স্কুলের আগের তিন তিন টা ধাপ পেরিয়ে নামকরা স্কুলে এবং কলেজে মোট (৩+১২) ১৫ টি বছর পরে যাদের ভাল রেজাল্ট হয় তাদেরও অনেকের জীবনে সাফল্যের খুশির দিশা মিলেনা আর, যাদের সেই ভাল রেজাল্ট নেই তাদের অবস্থার কথা তো আরও মর্মান্তিক। আমাদের সন্তানেরা কি এই সফল ব্যাবসা পদ্ধতির একটা উপকরন হয়ে থাকবে নাকি আমরা তাদের সুশিক্ষিত করার প্রয়াসে এর পরিবর্তন কামনা করব? আমাদের কি করনীয় এটা এখনি ভাবার সময়।
মোহাম্মাদ আনোয়ারুল গনি |
|
|
|
Ghani Academy, House-6,  Block-G,  South Banasree  (main road),  Dhaka-1219 Phone: 8801911323711
|